সমস্ত লেখাগুলি

কোভিড মহামারীর সময় বিজ্ঞানমস্কতা -
সৌরভ দেবনাথ
Nov. 18, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:501 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আমরা কি বিজ্ঞানমনস্ক? প্রথমেই এমন একটা বেয়াড়া প্রশ্ন শুনে অনেকেই রেগে উঠতে পারেন, অনেকেই ভ্রু, নাক কুঁচকে ' অ্যাঁ' সূচক শব্দ করতে পারেন। অনেকে বলবেন আলবাত বিজ্ঞানমনস্ক। এই যে বিজ্ঞানের এত অবদান আমরা ভোগ করছি, যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছি সবই তো বিজ্ঞানের দান এবং সেগুলো গ্রহণ করেছি। এই যে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোলেই অভিভাবকরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের ' সায়েন্স নিবি, সায়েন্স নিবি ' বলে কানের পোকা নাড়িয়ে দেন, এই যে ইঞ্জনিয়ারিং কলেজের ছড়াছড়ি। স্মার্টফোন, কম্পিউটারের মত জটিল যন্ত্রগুলো কত সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। 

                এখানে জানা দরকার বিজ্ঞান কি। আমরা যে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি এগুলোই কি বিজ্ঞান? আজ্ঞে না। এগুলো হলো বিজ্ঞানের ফল। বিজ্ঞান হলো প্রকৃতিকে তার নিয়মগুলি দিয়েই জানার পদ্ধতি। বিজ্ঞান শব্দের অর্থ ' বিশেষ জ্ঞান' বললে কিছুই বলা হয়না। প্রকৃতি কি ভাবে চলছে তার পরীক্ষালব্ধ, যুক্তিসঙ্গত উত্তর খুঁজে বের করাই বিজ্ঞানের মূল কাজ। বিজ্ঞানের দৌলতেই প্রকৃতির উপাদান এবং তাদের পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি। আর সেই নিয়মের ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন যন্ত্র বানাতে পারি। যেমন তাপগতিবিদ্যার সূত্র প্রথমে এসেছিল পদার্থবিদ ক্লডিয়াসের হাত ধরে। সেই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জেমস ওয়াট বানালেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে আজকের মোটরগাড়ির ইঞ্জিন। কাজেই বলা যায় বিজ্ঞান হলো প্রযুক্তির ভিত। 

                তাহলে বিজ্ঞানমনস্কতা কি? বিজ্ঞানমনস্কতা হলো প্রশ্নহীন আনুগত্যের একশোআশি ডিগ্রি বিপরীতে অবস্থান। সংশয়বাদী (skeptic) হ‌ওয়া। কোনো উত্তর খোঁজার আগে নিজের মনটাকে ফাঁকা শ্লেটের মত স্বচ্ছ রাখতে হবে। অর্থাৎ পূর্ব পরিকল্পিত উত্তর ভেবে সেটার পেছনে ধাওয়া করলে হবেনা। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে নভেম্বর ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠে বিখ্যাত 'রয়াল সোসাইটি'। যাদের লক্ষ্য ছিল 'নুলিয়াস ইন্ ভার্বা'। এই ল্যাটিন শব্দত্রয়ের মানে হলো ' কারো কথায় নয়', অর্থাৎ কেউ বলেছে বলে নয়, সত্যিটা নিজেকে যাচাই করতে হবে। গত সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সংস্থাটি বিজ্ঞানের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চাঁদের হাট হয়ে এসেছে। স্যার আইজ্যাক নিউটন, স্যার হামফ্রে ডেভি, চার্লস ডারউইন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, মাইকেল ফ্যারাডে, স্টিফেন হকিং আরো অসংখ্য নাম। এনারা যত বিখ্যাত ব্যক্তিই হননা কেনো, তাঁদের বক্তব্যের সাপেক্ষে প্রমাণ দিতে হয়েছে। তাই তো বিজ্ঞানে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া হয়না সেই ব্যক্তি বিখ্যাত বলে। 

                বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার মাঝে একটি যোগসূত্র আছে। এই যোগসূত্র হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। কি এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি? এটি হলো মুক্তমনে অনুসন্ধান, জ্ঞানার্জন পূর্ব জ্ঞানের সংশোধন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রথম ধাপ হলো কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ। এই পর্যবেক্ষণ সাধারণত আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হয়ে থাকে।দ্বিতীয় ধাপে একটা হাইপোথিসিস কল্পনা করা। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ঘটনাটির সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তৃতীয় ধাপে ঘটনাটি পরীক্ষা করে দেখা হয় ব্যাখ্যার সাথে ফলাফল মিলছে কিনা। যদি না মেলে তখন পূর্ব হাইপোথিসিস বাতিল করে নতুন হাইপোথিসিসের অবতারণা করা হয়। সব শেষে আসে সিদ্ধান্ত। তবে এরও কিছু শর্ত আছে। যেমন ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে পূর্বে কোনো পরীক্ষা হয়েছে কিনা দেখতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত বর্তমান সিদ্ধান্তের সাথে মেলাতে হবে। যদি দেখা যায় বর্তমান তত্ত্বটি পূর্বতন তত্ত্বের থেকে উন্নত ও বেশি সংখ্যক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম তখন পুরাতন তত্ত্বটি বাতিল করা হয়। বিশ্লেষনটি হতে হবে যুক্তিসম্মত। কোনরকম অতিপ্রাকৃতিক হস্তক্ষেপ বিশ্লেষণে থাকবে না। পরীক্ষাটি বার বার করা যেতে পারে এমন হতে হবে। আরো যে বিশেষ বৈশিষ্ট বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বের থাকতে হবে তা হলো ফলসিফায়াবিলিটি। দার্শনিক কার্ল পপারের মতে আদর্শ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলো যা কিনা মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে। এটাকেই বলা হয় পপারের ফলসিফয়াবিলিটি। যেমন নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। এখনো পর্যন্ত এটাই হয়ে এসেছে। এবার ভবিষ্যতে যদি কোনো ক্ষেত্রে এর অন্যথা দেখা দেয়। তবে নিউটনের এই সূত্র সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাবে। 

                এবার আসা যাক কোভিড প্রসঙ্গে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক মহামারী ও অতিমারীর পার্থক্য। মহামারী হলো যখন কোনো বিশেষ রোগের প্রাদুর্ভাব কোনো দেশের নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে যাকে ইংরাজিতে বলে ' Epidemic'। আর অতিমারী বা ' Pandemic'  হলো যখন সেই রোগ বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে রোগটি যখন সদ্য প্রকাশ পায় তখন তাকে বলে ' Outbreak'। এই অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করতে  না পারলে ক্রমশ তা মহামারী এবং তা থেকে অতিমারীর আকার ধারণ করে। কোভিডের ক্ষেত্রে এর উৎস চিনের উহান অঞ্চলে। ডিসেম্বরের শেষদিকে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১১ ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করে। কোভিড বা ইংরাজিতে Covid হলো Corona virus disease এর সংক্ষিপ্ত নাম। আর ১৯ হলো ২০১৯ সালকে বোঝানো হয়েছে। করোনা শব্দের অর্থ মুকুট। ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের জন্য এইরকম নাম। এই রোগটি মূলত শ্বাস যন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। রোগটি যখন অতিমারীর তকমা পেল তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ল এটি নাকি চিনের চক্রান্ত। বিজ্ঞানমনস্কতাকে বিসর্জন দিয়ে কাতারে কাতারে ইন্টারনেট পোস্ট হতে লাগলো এই খবর। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বিভিন্ন মতামত উঠে এলো। মুসলিম সম্প্রদায়ের মুমিনগণ নির্দ্বিধায় প্রচার চালালো চীনের ওপর এ ' আল্লাহর গজব '। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে এবং জমজমের পানি, কালো জিরে খেলে করোনা হবে না। পরে অবশ্য মক্কা বন্ধ করে হজ স্থান জীবাণুমুক্ত করতে হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনে উক্ত ধারণা গুলো শেকড় গেঁথে গেছে। খ্রিস্টীয় যাজকরা প্রচার করল পবিত্র জল একমাত্র মুক্তির উপায়। এত কিছুর পরেও পোপের শহর ভ্যাটিকানে মানুষের মৃত্যু ঘটতে লাগলো। পোপ গৃহবন্দী হয়ে রইলেন। ভারতে তখনও করোনা আসেনি। আয়ুষ মন্ত্রক নির্দ্বিধায় কোনরকম বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়াই প্রচার করতে লাগলো হোমিওপ্যাথিক আর্সেনিক অ্যালবাম ৩০ সি খেলেই করোনা হবে না। বিখ্যাত যোগীগুরু 'বাবা রামদেব' বললেন নিয়মিত যোগব্যামই একমাত্র অবলম্বন করোনার থেকে বাঁচার। ' চির আধ্যাত্মবাদের(?)' দেশ ভারতবর্ষ। মাঝে  অনেক জায়গায় গোমূত্র পানেরও আয়োজন হলো। কিন্তু এতকিছু করেও ধীরে ধীরে মাস্কবদনের সংখ্যাও বেড়ে চললো। ধীরে ধীরে আক্রান্তের খবর আসতে লাগলো। ধীরে ধীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিনেমা হল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হলো। ২২ শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী বারো ঘন্টার জনতা কার্ফিউ জারি করলেন এবং সকলকে বিকেল পাঁচটায় হাততালি দেওয়ার এবং কাসর, ঘন্টা, শঙ্খ বাজানোর আহ্বান জানালেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল করোনার জীবাণু বারো ঘন্টা জীবিত থাকে। এরকম কোনো তথ্য প্রমাণ তখনো মেলেনি। এছাড়া হাততালি, শঙ্খ বাজানোর অপবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এলো এরকম যে পাঁচটার সময় রেবতী নামক নক্ষত্র চাঁদের কাছ থেকে যাবে, সম্মিলিত আওয়াজ দেহের রক্তসঞ্চালন ঠিক রাখবে এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে।  বিখ্যাত তারকা অমিতাভ বচ্চন টুইট করলেন ঐদিন অমাবস্যা থাকায় সমস্ত অশুভ শক্তি, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষমতা বেড়ে যাবে। সম্মিলিত শঙ্খনিনাদ করোনা ভাইরাস ধ্বংস করে দেবে। এত কিছুর পরেও লকডাউন ঘোষনা করতে হলো। এরপর প্রধানমন্ত্রী আপামর ভারতবাসীকে ৯ ই এপ্রিল রাত ৯ টায় বাড়ির সব আলো নিভিয়ে প্রদীপ জ্বালাতে বললেন। এটার ওপরেও অনেক রকম ব্যাখ্যা এলো ইন্টারনেটে। কেউ বললেন একসাথে এতগুলি প্রদীপ জ্বালালে তার উত্তাপে ভাইরাস নষ্ট হয়ে যাবে। কেউ বললেন এর ফলে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রভাবে ভাইরাস মারা যাবে। যুক্তিবাদীরা অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিল প্রচণ্ড উত্তাপে মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না তা কি করে সম্ভব? এছাড়াও চীন মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে তবুও কোভিডের উৎপত্তি চীন কেনো? এছাড়াও শিলের ওপর নোড়া বসিয়ে তাকে শিবলিঙ্গ হিসেবে পূজো করা হতে লাগলো। যা নাকি কখনো হয়নি। এটি পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনেই যে হচ্ছে তা কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশবাসী মানতে নারাজ। বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক ধারণা যে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জতিক স্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে তারও প্রমাণ মিলল যখন আমেরিকায় মানুষ লকডাউনকে কাঁচকলা দেখিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। সরকার নাকি চক্রান্ত করে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে তাদের। প্রাক্তন ব্রিটিশ ফুটবলার 'ডেভিড আইক' তাঁর অপবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। তিনি এক টিভি শোতে বললেন ফাইভ জি প্রযুক্তি দেহের কোষের জন্য বিষাক্ত। শক্তিশালী তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র এর জন্য বিশেষ দায়ী। এই বক্তব্য অনেকের ওপরেই গভীর ক্ষোভ তৈরি করেছে ফাইভ জি প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। অনেক জায়গায় ফাইভ জি টাওয়ার ভেঙে ফেলা হয়েছে। অপবিজ্ঞান যে শুধু কুসংস্কারের ওপর নির্ভর হবে এমন নয়।হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের সামান্য ইতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছিল কোভিডের ওপর। তবে তা পুরোপুরি ভাবে বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠা পায়নি। এর মধ্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চেয়ে পাঠালেন ভারতের কাছ থেকে। সাধারণ মানুষ দোকানে গিয়ে মুড়ি মুড়কির মত কিনে খেতে লাগলো কোনো রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অবহিত না হয়েই। পরে দেখা গেলো তাতে ক্ষতি হচ্ছে অনেক বেশি। ২০২০ পেরিয়ে ২০২১ এ আমাদের ওপর আছড়ে পড়লো কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ। প্রত্যক্ষ করলাম দিনে প্রায় চার লক্ষের কাছে সংক্রমণ। এক বছরের মাথায় ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার পরেও ভুল ধারণার জন্য অনেকে নিতে চাইছেন না। 

                কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার এত অভাব কেনো? এর উত্তর আমাদের দিতে পারে বিবর্তন তত্ত্ব। যখন মানুষ শিকারি সংগ্রাহক ছিল তখন প্রতি পদে পদে ছিল মৃত্যুর আশঙ্কা। ছিল হিংস্র প্রাণীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। তাই কোনো রকম অস্বাভাবিক কিছু দেখলে তারা তার কারণ জানতে যাওয়ার থেকে পালানো শ্রেয় মনে করতো। এই অভ্যেস তখন সত্যি কাজে লেগেছিল। তার জন্যই মানবসভ্যতা যোগ্যতমের উদ্বর্তন নিয়ম মেনে এগিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু এখন তা মানবসভ্যতার ক্ষতি ছাড়া কিছু করছে না। উপরের ঘটনাগুলি কোনোটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেনা। যেমন ভাইরাসের জিনের সজ্জা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন এটি এসেছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারাই। এটি একটি আর এন এ জু নটিক ভাইরাস। তার মানে এটির জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল হলো আর এন এ এবং এটি মানুষের সংস্পর্শে আসার আগে কোনো প্রাণীদেহে নিজের মিউটেশন ঘটিয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন নব্বই থেকে পঁচানব্বই শতাংশ জিনের সজ্জার মিল রয়েছে বাদুড়ের সাথে। অর্থাৎ এটি কোনরকম জৈব অস্ত্র নয়। এছাড়া যোগব্যাম, হোমিপ্যাথি, কালো জিরে, আল্লাহর গজব এগুলো কোনোটাই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দ্বারা প্রমানিত নয়। এছাড়াও সম্মিলিত প্রদীপ জ্বালানো বা  হাততালির ওপর যে সকল অবৈজ্ঞানিক দাবি করা হয়েছে তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ যে বা যারা দাবি করছে তারা বলবে কোনো অলৌকিক উপায়ে হচ্ছে যা কিনা বিজ্ঞানের অজানা। এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। ফাইভ জি প্রযুক্তিতে যে মানবদেহে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব আছে এমন কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। কিন্তু বিজ্ঞান চেতনাহীন মানুষ তা বিশ্বাস করে চলেছে। এই রোগটি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া। কারণ এই ভাইরাসের সংক্রমণ হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। আর হাত ধোয়ার কারণ হলো যে কোনো ভাইরাসের জেনেটিক বস্তুটি ক্যাপসিড নামক প্রোটিন বা ফ্যাটের স্তর দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। সাবান এই স্তরটি ধ্বংস করে দেয়, ফলে ভাইরাসটির বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। আর কোনরকম রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু ভুল তথ্যগুলোতে কেউ যদি বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত থাকে এবং উপরোক্ত নিয়মগুলি মেনে না চলে তাহলে বিপদটা সেখানেই। যে কারণে বর্তমানে মুহুর্মুহু বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভুল খবর ছড়ানোকে নাম দিয়েছে 'Infodemic'। তাই প্রযুক্তির সাথে দরকার বিজ্ঞানমনস্কতা। লকডাউনের এই সময়টাকে কাজে লাগানো যেতে পারে নিজের বিজ্ঞানচেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখা যেতে পারে, বই পড়া যেতে পারে এর ওপর।

                মহামারী নতুন কোনো কিছু নয়। বন্য মানুষের সময়ও মহামারী ছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই যারা অনাক্রম্যতা পেয়েছে তারা টিকে গেছে। মিশরের মমির দেহেও গুটি বসন্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কিন্তু এডওয়ার্ড জেনারের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর ছবিটা বদলে যেতে থাকলো। ধীরে ধীরে অন্য রোগেরও ভ্যাকসিন এলো। পোলিও ও গুটি বসন্ত এমন দুটি রোগ যা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের দৌলতে আজ বিলুপ্ত। আর এত কিছু সম্ভব হয়েছে মানবজাতির দুর্দমনীয় কৌতূহলের কারণে। যা জন্ম দিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের। কারণ বিজ্ঞানমনস্কতা বিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর কোভিডও একসময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব এবং কুসংস্কার বা অপবিজ্ঞান বিশেষত অতিমারীর সময় ভয়াবহ একটি সংমিশ্রণ।

উই আর স্টার স্টাফ -
সৌরভ দেবনাথ
Nov. 9, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:306 | likes:65 | share: 0 | comments:0

রাত ৯টা বেজে গেছে। ধানক্ষেতের মাঝখান থেকে একটা ঢালাই রাস্তা দুটো গ্রামের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করেছে৷ সেই রাস্তা ধরে শঙ্খ আর কুশল ফিরছে তাদের বন্ধু পুষ্পকদের বাড়ি থেকে৷ গ্রাম বললেও এই গ্রামের প্রায় সব লোকের কাছেই স্মার্টফোন আছে৷ নেই শুধু বিজ্ঞানমনস্কতা৷ কুশল তার ফোনে টাইপ করে চলেছে কিছু একটা৷ সেই কিবোর্ডের টকাটক শব্দ শুনতে পাচ্ছে শঙ্খ৷ পুষ্পকদের বাড়িতে আজ বেজায় তর্ক হয়েছে পুষ্পকের সাথে৷ পুষ্পকের কোন দাদু নাকি জ্যোতিষি৷ ভদ্রলোক নাকি পুষ্পককে বুঝিয়েছেন যে ধর্ম আর বিজ্ঞানের কোনো তফাৎ নেই৷ প্রাচীন ঋষিরা অনেক কিছু জানতো বিজ্ঞানের ব্যাপারে৷ বিবেকানন্দ নিজেও সে কথা বলেছেন এমন যুক্তি টেনে বিজয়ী ভেবে নিল নিজেকে পুষ্পক৷ কুশল যথারীতি নিউট্রাল৷ সে মজা নিয়ে গেছে৷

       আকাশের দিকে তাকিয়ে শঙ্খ দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আজ অনেকগুলো তারা দেখা যাচ্ছে৷ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। কুশল এগিয়ে গেছিল মোবাইলে টাইপ করতে করতে৷ পেছন ফিরে দেখল শঙ্খ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ কুশল শঙ্খের কাছে গিয়ে বলল "বাড়ি চল অনেক রাত হলো।" কুশল সে কথায় কান না দিয়ে "বললো আজকের দিনটা কি জানিস?"

-“১৭ ই ফেব্রুয়ারি।’’

-"হ্যাঁ। কিন্তু আজকের দিনটার বৈশিষ্ট্য কি?”

-“জানিনা ভাই।”

-"আজ হলো এমন একজন মানুষের মৃত্যুদিন যাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম শহীদ বলা হয়। আজ জিয়র্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।"

-“এই জিয়র্দানো ব্রুনো কে?”

-“আমরা সবাই গ্যালিলিওর কথা জানি, কোপারনিকাসের কথা জানি৷ কিন্তু ব্রুনোর কথা আমরা শুনিনা৷ আজ যখন পুষ্পক তার দাদুর বলা বুলি আওড়ে বলল বিজ্ঞান আর 'ধর্ম একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ' তখনই বিজ্ঞানের জন্য যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের আত্মবলিদান নস্যাৎ করে দিল সে৷

-“আচ্ছা শঙ্খ একটা কথা তো মানবি যে স্পিরিচুয়ালিটি বলে কিছু হয়?”

-“আচ্ছা কুশল, তুই আমাকে স্পিরিচুয়লিটির সংজ্ঞাটা বল তো? ইউটিউবে যে বাবাজিরা সং সেজে স্পিরিচুয়লিটির কথা বলে সেটা? যারা অপবৈজ্ঞানিক কথা বলে তারা? যারা ব্যাকগ্রাউন্ডে ওম সাউন্ড চালিয়ে জ্যোতিষচর্চা করে তাদের স্পিরিচুয়ালিটি?”

-“তুই বলছিস বটে কিন্তু তাঁরা যদি ঠিক নাই হবে তাহলে তাঁদের এত ভক্ত কেনো হবে?”

-“শোন তবে একটা কথা বলি। প্রথমত আমার কাছে স্পিরিচুয়ালিটি হলো রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার যে অনুভূতি। যত দূরে তারা আমি দেখি তারা তত পুরনো। কার্ল সাগান যে বলে গেছেন 'উই আর স্টার স্টাফ' তার মানে আমার শরীরের প্রতিটা উপাদান তারাদের থেকে জন্ম নিয়েছে। আমার শরীরের প্রতিটা হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম পরমাণুর বয়স মহাবিশ্বের বয়সের সমান। আমি রাতের আকাশের দিকে তাকালে এমন অনেক তারা দেখতে পাচ্ছি যেগুলোর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই যে অনুভূতিগুলো এটাই আমার কাছে স্পিরিচুয়ালিটি।

     আর তুই যে বলছিস যে সেইসব স্পিরিচুয়াল বাবাজিদের এত ভক্ত কেনো, আমাকে বল তো যদি গণবিশ্বাস বিজ্ঞান হতো তাহলে গ্যালিলিও, কোপারনিকাস এনারাও তো ভুল। আজও মহাবিশ্ব পৃথিবীকেন্দ্রিক হতো। তা তো নয়?"

-“হুম। ঠিকই বলেছিস তুই। আচ্ছা এই জিয়র্দানো ব্রুনোর ব্যাপারে তুই যা জানিস একটু বল তো”

-“ইউরোপের চার্চের কিরকম নিপীড়ন ছিল সে তো কিছু কিছু জানিস। ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি সবই একসাথে ছিল। চার্চের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই মৃত্যুদণ্ড। ষোলো শ শতকে কোপারনিকাস তাঁর বইতে লিখলেন মহাবিশ্ব সৌরকেন্দ্রিক। কিন্তু ধর্মের ষাঁড়গুলো কেনো মেনে নেবে? তাদের ধর্মের ওপর নাকি অপমান হয়েছে। কিন্তু একজন পাদ্রী ছিল যে কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের সমর্থন শুধু নয় তা প্রচারও করতো। এমনকি একধাপ এগিয়ে বলতে শুরু করলো মহাবিশ্ব অসীম। দূরের যে তারাগুলো তারাও এক একটা সূর্য। তাদের চারপাশে আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহ ঘুরছে। আমাদের সূর্য সেই তারাদের মতোই একটা তারা। তখনকার দিনের চার্চের নিষিদ্ধ বিজ্ঞানের বইও সে লুকিয়ে পড়ত।”

-“এখানে একটা কথা বলতে চাই যে তার কাছে তো কোনো প্রমাণ ছিলনা?”

-"না। কারণ টেলিস্কোপ তখনও আসেনি। অ্যাস্ট্রোনমাররা খালি চোখেই দেখতো ধৈর্য্য ধরে। ব্রুনোর সব কথা হয়তো ঠিক নয়। সে তার সময়ের ফসল। কিন্তু তার কৃতিত্ব এখানেই সে বৈপ্লবিক একটা ভাবনা ভেবেছিল। চার্চের ধরাবাঁধা গণ্ডির বাইরে বেরোতে চেয়েছিল। চার্চের সেটা সহ্য হবার কথা নয়। হয়ওনি। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ পেল। সেখানে গিয়ে নিজের ভাবনার সব উজাড় করে দিতে চাইল। কোপারনিকাসের সমর্থনে বলতে চাইল। কিন্তু সেখানেও তাঁকে অপমানিত হতে হলো। সবাই বলতে লাগলো সে হেরেটিক বা অধার্মিক। আট বছর তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়। অকথ্য অত্যাচার করা হতো তাঁকে। বলা হতো যাতে মেনে নেয় সে যা বলেছে সব ভুল। কিন্তু সে ছিল ব্রুনো। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় অটল। ইনকুইজিশন নামক প্রহসন চললো। সেখানেও কার্ডিনাল তাকে ক্ষমা চাইতে বলল। কিন্তু ব্রুনো তার ভাবনা থেকে এক চুলও সরে দাঁড়াতে নারাজ। অবশেষে ষোল-শ খ্রিস্টাব্দে আজকের দিনেই রোমের ক্যাম্প্যে ডি ফিওরি স্কোয়ারে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয় ব্রুনোকে। রোমের জনগন সেদিন পুড়ে যেতে দেখেছিল এক অবিশ্বাসীকে। সবাই ভেবেছিল তাদের ধর্ম বুঝি রক্ষা পেল। কিন্তু তারপর আমরা সবাই জানি সত্যিটা কি। সবথেকে বড় কথা কি জানিস তো আমরা এতকিছু জানার পরেও বলব বিজ্ঞান আর ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। সত্যিই কি তাই? এখনকার দিন গুলোতে দেখ তো একবার বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান এনাদের পরিণতি। আমাদের দেশেই নরেন্দ্র দাভলকার যিনি চেয়েছিলেন কুসংস্কার বিরোধী আইন আনতে তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো। এদেশে এখনও ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ খুন হয়। এত কিছুর পরেও যদি বলো বিজ্ঞান আর ধর্ম একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ তাহলে এই মানুষগুলোর অপমান।"

     এরকম একটা ঘটনা শুনে কুশলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে বলল "আচ্ছা আমাদের তবে কি করণীয়?”

-"আমরা যদি বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারি, সবসময় যদি বিজ্ঞানের প্রচার করি, কুসস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে পারি তাহলেই তাঁদের বলিদান বিফলে যাবেনা। তুই, পুষ্পক তোরা যেদিন তোদের হাতের জ্যোতিষ রেকমেন্ডেড আংটিগুলো খুলে ফেলতে পারবি, যেদিন মনের সব ভয় দূর করে জাত, ধর্ম, বর্ণ ভুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন থেকে বলতে পারবি 'উই আর স্টার স্টাফ' সেইদিন হয়তো সেই মানুষগুলো যথাযথ সম্মান পাবেন।"

     দুজনেই এরপর আবার হাঁটা শুরু করলো। শঙ্খ লক্ষ্য করলো কুশল আংটিগুলো খুলে নিজের পকেটে রাখলো। শঙ্খের দিকে তাকিয়ে বললো “চেষ্টা করবো এগুলো যাতে আর না পরতে হয়”

শঙ্খ শুনতে পেল কুশল মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে বলছে “উই আর স্টার স্টাফ।”


ইঞ্জিনিয়ারিং ইতিকথা -
সৌরভ দেবনাথ
Nov. 9, 2024 | টেকনোলজি | views:303 | likes:28 | share: 1 | comments:0

ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রযুক্তিবিদ্যা বর্তমানে বিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে এর সামান্য পার্থক্য আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পূর্ণ ভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় তেমন ছিলনা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আগে প্রযুক্তিবিদ্যা ছিল ঠেকে শেখার মত। প্রয়োজনের তাগিদ সবথেকে বড় তাগিদ। তাই গুহামানবদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে কারিগরিবিদ্যার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। চাকার ব্যবহার হলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা মানবসভ্যতাকে অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে দিয়েছে। এরপর আমরা দেখতে পাই প্রাচীনতম সভ্যতার কিছু নিদর্শন যা আমাদের বিস্মিত করে। মিশরের পিরামিড, পেরুর মাচুপিচু, ইস্টার দ্বীপের বৃহৎ সব মূর্তি, ভারতের চাঁদ বাওরি, রোমান স্থাপত্য, বন্যা রোধের জন্য মিশরের বাঁধ, রোমান জলাধার আরো অসংখ্য সব নিদর্শন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির ব্যবহার অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তাই এই সকল নিদর্শন যতই মানুষের দ্বারা অসম্ভব মনে হোক না কেনো (কিছু কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীদের মতে ভিনগ্রহীদের সাহায্যে এইসব বানানো হয়েছে) তা মানুষের কারিগরিবিদ্যার ফসল। 

              গ্যালিলিওকে বলা হয় আধুনিক বিজ্ঞানের জনক। সবকিছু পরীক্ষা দ্বারা যাচাই করার কথা তিনি বলতেন। তাঁর বানানো দূরবীন যখন তিনি রাতের আকাশের দিকে ফেরালেন সেটাই ছিল সম্ভবত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার শুরু। এরপর ধীরে ধীরে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, গতির সূত্র এছাড়া আরো অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আবির্ভাব হতে লাগলো। বিজ্ঞানকে বলা হতো প্রাকৃতিক দর্শন। এরপর থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনিয়ারিং গতি লাভ করে। ১৭৬০ এর সময় থেকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে ওঠে। তার সাথে প্রয়োজন হয়ে পড়ে দ্রুত অনেক বেশি পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানির। এছাড়া কম বিনিয়োগে বেশি লাভের আশা দেখতে শুরু করে কারখানার মালিকরা। প্রয়োজন হয় ইঞ্জিনিয়ারদের। বাষ্পীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে থমাস নিউকোমেন বানালেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন। সেই ডিজাইন উন্নত করলেন জেমস ওয়াট। সেই শুরু ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে সভ্যতার অগ্রগতি। এরপর জর্জ স্টিফেনসন ও তাঁর পুত্র রবার্ট স্টিফেনসন যাত্রীবাহী রেল ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। রকেট নামক লোকোমোটিভ ছিল তখনকার দ্রুততম যানবাহন। এগুলো সবই মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফল। এই ক্ষেত্রে যাঁদের কথা না বললেই নয় তাঁরা হলেন রুডলফ ডিজেলের ও নিকোলাস অটো। ডিজেল ইঞ্জিন ও পেট্রোল ইঞ্জিনের নাম আমরা সবাই মোটামুটি জানি। ডিজেল ও পেট্রোল ইঞ্জিনের উদ্ভাবক যথাক্রমে রুডলফ ডিজেল ও নিকোলাস অটো। এই দুই ইঞ্জিনকে বলা হয় ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিন। অর্থাৎ জ্বালানী দহন করে তার দ্বারা উৎপন্ন গ্যাস পিস্টনকে ঠেলে দেয়। জার্মান উদ্ভাবক কার্ল বেঞ্জ ইঞ্জিনের ব্যবহার করে তৈরি করলেন প্রথম মোটরগাড়ি। 

              আমাদের বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। কয়েক মিনিট বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। হৃৎপিণ্ড যেমন সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে এবং তা ব্যাহত হলে শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও যেন সেরকম। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ব্যাহত হলে জনজীবন থমকে যাবে। বর্তমানে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি তা হলো এ.সি. বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থারও একটা ইতিহাস আছে যা 'কারেন্ট ওয়ার ' নামে খ্যাত। সারা পৃথিবীতে এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁরা হলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদেরও একটা ইতিহাস আছে। প্রাচীন গ্রিকরা পশম ও অ্যাম্বার একে অপরের সাথে ঘষে দেখেছিল দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। এটি ছিল স্থির তড়িৎ। এরপর প্রায় দুই হাজার বছর পর একই ঘটনা লক্ষ্য করেন রানী এলিজাবেথের ডাক্তার উইলিয়াম গিলবার্ট। এরপর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা প্রথম তড়িৎকোষ বানালেন। সালফিউরিক অ্যাসিডে তামা ও দস্তার পাত দিয়ে বানালেন প্রথম ব্যাটারি যা ছিল রাসায়নিক শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তর। এরপর মাইকেল ফ্যারাডে দেখলেন তার কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে চুম্বক নিয়ে গেলে গ্যালভানোমিটারের কাঁটা নড়ে উঠছে। সেই ছিল বৈদ্যুতিক জেনারেটর তৈরির প্রথম ধাপ। এছাড়াও বৈদ্যুতিক মোটরের ধারণাও তিনিই প্রথম দেন। এছাড়াও তড়িৎ ও চুম্বকত্ব একে অন্যের পরপূরক তা তিনিই প্রথম বলেন। কিন্তু রয়্যাল সোসাইটি প্রথমে মেনে নেয়নি। তার উদ্ধারকারী হিসেবে এলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। যিনি গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে দেখালেন ফ্যারাডের তত্ত্বকে। ফ্যারাডের শিক্ষক স্যার হামফ্রে ডেভি ভোল্টাইক কোষ দিয়ে আর্ক ল্যাম্প বানানোর প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু তা ছিল প্রচুর উজ্জ্বল ও ক্ষণস্থায়ী। এরপর আমেরিকান উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন দীর্ঘস্থায়ী বৈদ্যুতিক বাতি বানালেন। তিনি কয়লাশক্তি পরিচালিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও বানালেন। এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল ডি.সি বা ডাইরেক্ট কারেন্ট। কিন্তু ডি.সি ব্যবস্থায় অসুবিধা হলো তড়িৎ পরিবাহীর প্রস্থছেদ অনেক বেশি হতে হবে এবং তা খুব বেশি দূর পর্যন্ত তড়িৎ পরিবহনে অক্ষম। সেই সময় মাঠে নামলেন আরেক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জর্জ ওয়েস্টিংহাউস। তিনি তার এ.সি বা অল্টারনেটিং কারেন্ট ব্যবস্থা প্রসারে বদ্ধ পরিকর। পরবর্তীকালে তিনি পাশে পেয়েছিলেন এডিসনের জেনারেল ইলেকট্রিক ত্যাগ করা সাইবেরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার নিকোলা টেসলাকে। নিকোলা টেসলা তিন ফেজের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার জনক। তাছাড়া তিন ফেজের বৈদ্যুতিক মোটর ও এক ফেজের বৈদ্যুতিক মোটর উদ্ভাবন করেন। এই এ.সি বিদ্যুতের সুবিধা হলো উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বহু দূরে বিদ্যুৎ প্রেরণ করা যায় বিদ্যুৎ অপচয় কম করে ও স্বল্প প্রস্থের তার ব্যবহার করে। ট্রান্সফরমার যন্ত্রের সাহায্যে ইচ্ছে মত ভোল্টেজ বাড়ানো বা কমানো যায়। এই টেসলার  জন্যই ওয়েস্টিংহাউস কারেন্ট যুদ্ধে জিতে যান যার ফল স্বরূপ এখনো এ.সি ব্যবস্থাই আমরা দেখতে পাই। 

              ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর দৌলতে আরেকটি বিভাগ একটু একটু করে বাড়তে থাকে যা হলো কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। বহুদূরে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাথমিক পদ্ধতি ছিল চিঠি আদান প্রদান। তারের মধ্য দিয়ে তড়িৎ পরিবহনকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হলো টেলিগ্রাফ। চার্লস হুইটস্টোন প্রথম বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ পেটেন্ট করান। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল উদ্ভাবন করলেন টেলিফোন। ম্যাক্সওয়েল লক্ষ্য করেছিলেন পরিবর্তনশীল তড়িৎক্ষেত্র ও পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র একে অপরের উৎপাদনের জন্য দায়ী। এই পরিবর্তন তরঙ্গের আকারে একটি নির্দিষ্ট গতিতে উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ে যা আলোর গতির সমান। বিজ্ঞানের জগতে এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। বিজ্ঞানের আলাদা দুই তত্ত্বকে (আলো ও তড়িৎচুম্বকত্ব) এক সূত্রে গেঁথে দিলেন। একদিকে যেমন আপেক্ষিকতাবাদের ভিত্তি স্থাপন করলেন অপরদিকে খুলে দিলেন যোগাযোগ ব্যবস্থার দুয়ার। প্রথমে তা গণিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক হার্জ প্রথম খুঁজে পেলেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। মানব সভ্যতা আয়ত্ত করলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ গতি, আলোর গতি। মার্কনি অ্যান্টেনা বানিয়ে আটলান্টিকের পেরিয়ে রেডিও তরঙ্গ পাঠাতে সক্ষম হলেন। 

              বর্তমানে জটিল সব গাণিতিক সমাধান দ্রুত সম্ভব হচ্ছে ক্যালকুলেটরের দৌলতে। এছাড়া বিজ্ঞানের সকল গণনা, সিমুলেশন সব সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের জন্য। এছাড়াও বর্তমান ল্যাপটপ, মোবাইলের শক্তিশালী প্রসেসরের বাহারী সব নাম আমরা শুনতে পাই সেই সবই সম্ভব হয়েছে ট্রানজিস্টর নামক যন্ত্রের আবিষ্কারের জন্য। এই ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের আগে যে যন্ত্র ব্যবহার হতো তা হলো ভ্যাকুম টিউব। এই ভ্যাকুম টিউবের আরেকটি ব্যবহার হলো বৈদ্যুতিক সংকেত বর্ধিত করা। কিন্তু তাতে প্রচুর বৈদ্যুতিক শক্তিক্ষয় হতো। ১৯৪৮ সালে জন বারডিন, উইলিয়াম শকলে ও ওয়াল্টার ব্র্যাটেন আবিষ্কার করেন ট্রানজিস্টর। ১৯৫৬ সালে তিনজনই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর বৈদ্যুতিক বর্তনী অনেক ছোট এবং কম বৈদ্যুতিক ক্ষমতা সম্পন্ন বানানো সম্ভব হয়েছে। এরপর জ্যাক কিলবি তৈরি করেন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট। ধীরে ধীরে ট্রানজিস্টরের আকার ছোট হতে থাকে। এরপর আমেরিকার ইনটেল কোম্পানি ১৯৭১ সালে বানায় তাদের প্রথম প্রসেসর ইনটেল ৪০০৪। এরপর আরো শক্তিশালী প্রসেসর তৈরি হতে থাকে যার ফসল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের অতি দ্রুত গণনক্ষমতাসম্পন্ন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ। 

              ১৯০৩ সালে রাইট ভাতৃদ্বয় প্রথম আকাশে ওড়েন। সেই ছিল প্রথম বিমান আবিষ্কার। এর মাত্র ৬৬ বছর পর ১৯৬৯ সালে নাসা প্রথম চাঁদের মাটিতে মানুষ পাঠাতে সক্ষম হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ত্বরণ প্রদান করেছিল। কিন্তু এতসব কিছুই সম্ভব ছিলনা ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া। দৈনন্দিন আরামদায়ক জীবনের কথা বাদ দিলেও বর্তমানে বিজ্ঞানের গভীর কিছু প্রশ্ন যেমন মহাবিশ্বের উৎপত্তি, মহাকাশ গবেষণা এইসব কোনো কিছুই ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯৯০ তে নাসা মহাকাশে পাঠায় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এখনো পর্যন্ত এটা থেকে প্রায় ষোলো হাজার রিসার্চ পেপার বের হয়। ২০১৫ তে আবিষ্কার হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্ৰ্যাভিটেশনাল ওয়েভ যা প্রমাণ করল আইনস্টাইনের ভবিষ্যৎবাণী, ২০১৯ সালে আমরা দেখতে পেলাম কৃষ্ণ গহ্বরের ছবি, সার্নের কণা ত্বরণ যন্ত্র তো বিজ্ঞানের জগতে এক দুর্দান্ত আবিষ্কার যা বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় অনবদ্য অবদান রেখেছে। আর এই সবকিছুই অসম্ভব রয়ে যেত ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মূল ভিত্তিই হলো পরীক্ষার দ্বারা যাচাই করা। আর বিজ্ঞানীরা ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর পরীক্ষার যন্ত্রপাতির জন্য সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল। অপরদিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং অন্ধের যষ্ঠী ছাড়া পথ চলার মত। তাই বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং একে অন্যের পরিপূরক। একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। 

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930